কুরআন নাজিল অনুসারে পর্যায়ক্রমে সংরক্ষণ না করে মুসলিমরা কি একে বিকৃত করেনি?
মুসলমান দা'য়ী হতে সাধারণ মানুষ, সবার মাঝে এই ধারণা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে যে, বাইবেল বিকৃত। এটা করার মূল কারণ কোন মুসলমান যেন প্রথম থেকেই বাইবেলকে সন্দেহের মাঝে রাখে। কিন্তু বাইবেলের পান্ডুলিপিগুলোর মাঝে কোন শব্দ বা বাক্যের ভিন্নতা থাকলে এ নিয়ে বাইবেল স্কলাররা বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এর ফলে বাইবেলের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে আমরা আরো বেশী নিশ্চিত হতে পারি। কিন্তু বাইবেলের বিরূদ্ধে যারা এই অভিযোগ আনেন তারা নিজেদের কিতাব নিয়ে সম্ভবত নিজেরাই চিন্তা করেনা, করলে এরকম অভিযোগ বাইবেলের বিরূদ্ধে তারা করতেন না। কারণ আমরা জানি কুরআনেরও অনেক ভ্যারিয়েন্ট আছে যা নিয়ে আলোচনা খুব কমই হয়ে থাকে, যে কারণে মানুষ এ সম্পর্কে জানে খুবই কম।
কুরআন যেভাবে নাজিল হয়েছিল সুরা ও আয়াতের সেই ধারাবাহিকতা অনুসারে তা কিন্তু পরে সেইভাবে সংরক্ষিত করা হয় নাই। খলিফারা সুরাগুলোর বর্তমান ক্রমে সাজিয়েছেন। এটা করতে গিয়ে তারা নাজিলের ধারাবাহিকতায় বিচ্যুতি ঘটিয়েছেন। ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ কোন কোন আয়াত কোন সুরায় থাকবে এ বিষয়ে কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানা যায়। কিন্তু তিনিও বর্তমান সুরার বিন্যাসে কুরআন সংরক্ষণ করতে বলে যাননি। কুরআনের প্রথম নাজিল হওয়া সুরা আল-আলাক। কিন্তু এটা বর্তমানে কুরআনে আছে ৯৬ নম্বরে। নাজিলের ধারা অনুযায়ী ১১৩ নম্বরে নাজিল হওয়া সুরা আত তাওবা বর্তমান কুরআনে আছে ৯ নম্বরে। এ দুটো উদাহারন থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারছি নাজিলের ক্রম কি ভয়ানকভাবেই না লংঘিত হয়েছে। আমরা এই মুসলিম ওয়েবসাইটের লিংক থেকে নাজিলের ধারাবাহিকতায় কুরআনের সুরা ও আয়াত এবং এগুলোর বর্তমান কুরআনে অবস্থান সম্পর্কে একটা ধারণা পাব-
https://tanzil.net/docs/revelation_order
বাইবেল মোটামুটি ধারাবাহিকভাবে লিখিত হয়েছে। তোরাহ(বাইবেলের প্রথম পাচটি বই) বা নিয়ম/ব্যবস্থা সংক্রান্ত বই বাইবেলের প্রথমেই আছে। এর পরে মূলতঃ ইতিহাস সংক্রান্ত বইগুলো পর্যায়ক্রমে সাজানো আছে। বাইবেলের নিয়ম কানুন বা ব্যবস্থা কুরআনের মত সময়ে সময়ে পরিবর্তন হয়নি। তাই বাইবেলের ক্ষেত্রে বইগুলোর ধারাবাহিকতা আইন কানুনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কিন্তু ধারাবাহিক ইতিহাস জানার জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। আর আমরা দেখতে পাই বাইবেলের বইগুলো ধারাবাহিকভাবেই আছে একমাত্র ইয়োবের বইটি ছাড়া যেটি মূলত ইতিহাসের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার জন্য । নতুন নিয়মের ক্ষেত্রে বইগুলো মূলত ছিল শিক্ষামূলক। এখানে ধারাবাহিকতা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এসবই একটি সুপরিকল্পিত ধীশক্তিসম্পন্ন সত্ত্বার নিয়ন্ত্রণে হয়েছে বলে আমরা অনুভব করি।
কিন্তু কুরআনের ক্ষেত্রে বিষয়টি সেরূপ নয়। কুরআনের অনেক বিধান পরবর্তী কোন আয়াত দ্বারা বাতিল বা রহিত হয়েছে। এজন্য কুরআনের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। কুরআনের আয়াতেও বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। তাফসীরসহ বর্ণনা করা হল-
✅ Al-Isra' ১৭:১০৬
وَقُرْءَانًا فَرَقْنَٰهُ لِتَقْرَأَهُۥ عَلَى ٱلنَّاسِ عَلَىٰ مُكْثٍ وَنَزَّلْنَٰهُ تَنزِيلًا
Bengali - Bayaan Foundation
আর কুরআন আমি নাযিল করেছি কিছু কিছু করে, যেন তুমি তা মানুষের কাছে পাঠ করতে পার ধীরে ধীরে এবং আমি তা নাযিল করেছি পর্যায়ক্রমে।
Bengali - Mujibur Rahman
আমি কুরআন অবতীর্ণ করেছি খন্ড খন্ডভাবে যাতে তুমি তা মানুষের কাছে পাঠ করতে পার ক্রমে ক্রমে; এবং আমি তা যথাযথভাবে অবতীর্ণ করেছি।
Bengali - Muhiuddin Khan
আমি কোরআনকে যতিচিহ্ন সহ পৃথক পৃথকভাবে পাঠের উপযোগী করেছি, যাতে আপনি একে লোকদের কাছে ধীরে ধীরে পাঠ করেন এবং আমি একে যথাযথ ভাবে অবতীর্ণ করেছি।
English - Sahih International
And [it is] a Quran which We have separated [by intervals] that you might recite it to the people over a prolonged period. And We have sent it down progressively.
Bengali - Tafsir Ibn Kathir
<b> ১০৫-১০৬ নং আয়াতের তাফসীর </b>
আল্লাহ তাআলা স্বীয় নবীকে (সঃ) বলেনঃ কুরআন সত্যসহ অবতীর্ণ হয়েছে। এটা সরাসরি সত্যই বটে। আল্লাহ তাআলা স্বীয় জ্ঞানের সাথে এটা অবতীর্ণ করেছেন। তিনি নিজেই এর সত্যতার সাক্ষী এবং ফেরেশতারাও সাক্ষী। এতে ঐ জিনিসই রয়েছে যা তিনি নিজের জ্ঞানে অবতীর্ণ করেছেন। এর সমস্ত হুকুম-আহকাম এবং নিষেধাজ্ঞা তার পক্ষ হতেই রয়েছে। সত্যের অধিকারী যিনি তিনিই সত্যসহ এটা অবতীর্ণ করেছেন এবং সত্যসহই তোমার কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। না পথে কোন বাতিল এতে মিলিতহয়েছে, না বাতিলের এ ক্ষমতা আছে যে, এর সাথে মিশ্রিত হতে পারে। এসব হতে এই কুরআন সম্পূর্ণরূপে রক্ষিত। এটা পরিবর্তন ও পরিবর্ধনহতেও পাক ও পবিত্র। পূর্ণক্ষমতার অধিকারী বিশ্বস্ত ফেরেশতার মাধ্যমে এটা অবতীর্ণ হয়েছে। যে ফেরেশতা আকাশে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী ও নেতা। হে নবী (সঃ)! তোমার কাজ হলো মু'মিনদেরকে সুসংবাদ দেয়া ও কাফিরদেরকে ভয় প্রদর্শন করা। এই কুরআনকে আমি লওহে মাহফুযের ‘বায়তুল ইয্যাহ’এর উপর অবতীর্ণ করেছি, যা প্রথম আকাশে রয়েছে। সেখান থেকে অল্প অল্প করে ঘটনা অনুযায়ী বিচ্ছিন্নভাবে তেইশ বছরে দুনিয়ায় অবতীর্ণ হয়েছে। এর দ্বিতীয় কিরআত فُرَّقْنَاهُ রয়েছে। অর্থাৎ এক একটি করে আয়াত তাফসীর ও বিশ্লেষণসহ অবতীর্ণ হয়েছে, যাতে তুমি লোকদের কাছে সহজেই পৌঁছিয়ে দিতে পার এবং ধীরে ধীরে তাদেরকে শুনিয়ে দিতে সক্ষম হও। আমি এগুলিকে অল্প অল্প করে অবতীর্ণ করেছি।✅
এই আয়াতের সমর্থক আরেকটি আয়াত দেখি-
✅Al-Insan ৭৬:২৩
إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا عَلَيْكَ ٱلْقُرْءَانَ تَنزِيلًا
Bengali - Bayaan Foundation
নিশ্চয় আমি তোমার প্রতি পর্যায়ক্রমে আল-কুরআন নাযিল করেছি।
Bengali - Mujibur Rahman
আমি তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি পর্যায়ক্রমে।
Bengali - Muhiuddin Khan
আমি আপনার প্রতি পর্যায়ক্রমে কোরআন নাযিল করেছি।
English - Sahih International
Indeed, it is We who have sent down to you, [O Muhammad], the Quran progressively.✅
উপরের আলোচনায় এটা পরিস্কার যে, কুরআনের আল্লাহ ধারাবাহিকভাবে কুরআন নাজিল করেছিলেন। এর বিশেষ কারণ এটাও ছিল যেন পূর্ববর্তী বিধান ও পরবর্তী বিধান সম্পর্কে মুসলিমরা ধারণা লাভ করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। একারণে কুরআনেই বলা হয়েছে, আল্লাহ কোন আয়াতকে রহিত বা ভুলিয়ে দিতে চাইলে আরও উত্তম আয়াত নাজিল করেন[1]। কিন্তু কুরআনের সেই ধারাবাহিকতা ইসলামের খলিফারা নিজেদের খেয়ালখুশি মত পরিবর্তন করেছেন। যার ফলে কোন মুসলিম বা অমুসলিম আজ কুরআন পড়ে এটা বুঝতে অক্ষম কোন আয়াতের বিধান কোন আয়াত দ্বারা রহিত হয়েছে। এজন্য তারা তাদের তাফসিরকারকদের উপর নির্ভরশীল। অথবা অনেক সময় ও শ্রম দিলে হয়ত নিজেরাই জানতে পারবে। প্রশ্ন হল মুসলিম খলিফারা কি নিজেদের আল্লাহর চেয়েও অধিক প্রজ্ঞাবান মনে করেছিলেন যে কারণে তারা আল্লাহর পর্যায়ক্রমে নাজিল করা কুরআনকে এলোমেলো করেছেন? এটা কি কুরআন বিকৃতির পর্যায়ে পড়ে না? খলিফাদের এই কাজগুলো কি কুরআন বিরোধী নয়?
তথ্যসূত্রঃ
[1] Al-Baqarah ২:১০৬
مَا نَنسَخْ مِنْ ءَايَةٍ أَوْ نُنسِهَا نَأْتِ بِخَيْرٍ مِّنْهَآ أَوْ مِثْلِهَآۗ أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ
Bengali - Bayaan Foundation
আমি যে আয়াত রহিত করি কিংবা ভুলিয়ে দেই, তার চেয়ে উত্তম কিংবা তার মত আনয়ন করি। তুমি কি জান না যে, আল্লাহ সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।
Bengali - Mujibur Rahman
আমি কোন আয়াতের হুকুম রহিত করলে কিংবা আয়াতটিকে বিস্মৃত করিয়ে দিলে তদপেক্ষা উত্তম অথবা তদনুরূপ আয়াত আনয়ন করি। তুমি কি জাননা যে, আল্লাহ সর্ব বিষয়ের উপরই ক্ষমতাবান?
Bengali - Muhiuddin Khan
আমি কোন আয়াত রহিত করলে অথবা বিস্মৃত করিয়ে দিলে তদপেক্ষা উত্তম অথবা তার সমপর্যায়ের আয়াত আনয়ন করি। তুমি কি জান না যে, আল্লাহ সব কিছুর উপর শক্তিমান?
English - Sahih International
We do not abrogate a verse or cause it to be forgotten except that We bring forth [one] better than it or similar to it. Do you not know that Allah is over all things competent?
0 coment rios: