(একটি বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা)
খ্রিস্ট বিশ্বাসীগণের মধ্যে প্রার্থনার সময় মেয়েদের মাথা ঢাকা উচিৎ কিনা - এ নিয়ে দুটি বিতর্কিত মত দেখা যায় - ১) প্রার্থনার সময় মাথা ঢাকতে হবে, ২) প্রার্থনার সময় মাথা ঢাকা আবশ্যকীয় নয়।
যারা বলেন, প্রার্থনার সময় মেয়েদের মাথা ঢাকার প্রয়োজন নেই, তাদের নানাবিধ ব্যাখ্যার আসল পয়েন্টটি হল এই যে, মেয়েদের মাথার আবরণী হল তাদের লম্বা চুল। সেক্ষেত্রে মেয়েদের লম্বা চুল হল আবৃত মস্তিষ্কের ব্যাখ্যা। তাই আলাদাভাবে মাথা ঢাকা আবশ্যকীয় নয়। এর স্বপক্ষে তারা বাইবেলের এই পদটি উদ্ধৃত করেন:
"কিন্তু স্ত্রীলোক যদি লম্বা চুল রাখে; তবে তাহা তাহার গৌরবের বিষয়; কারণ *সেই চুল আবরণের পরিবর্ত্তে* তাহাকে দেওয়া হইয়াছে।"
(১ করিন্থীয়, ১১:১৫, অনুবাদ: কেরী)
অন্যদিকে যারা বলেন, প্রার্থনার সময় মাথা ঢাকা বাধ্যতামূলক, তারা বাইবেলের এই পদটি বিশেষভাবে উদ্ধৃত করেন:
"কিন্তু যে কোন স্ত্রী অনাবৃত মস্তকে প্রার্থনা করে, কিম্বা ভাববাণী বলে, সে আপন মস্তকের অপমান করে; কারণ সে নির্ব্বিশেষে মুণ্ডিতার সমান হইয়া পড়ে।"
(১ করিন্থীয় ১১:৫, অনুবাদ: কেরী)
স্বাভাবিকই এই দুটি মতের মধ্যে দুটি মতই সঠিক হতে পারে না; যেকোনো একটি মতই সঠিক বলে বিবেচিত হবে।
এক্ষেত্রে আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে একটি তুলনামূলক জবাব এখানে পেশ করছি।
প্রথমেই আমরা খেয়াল করি যে, মেয়েদের প্রার্থনার ক্ষেত্রে মাথা ঢাকার কথা ১ করিন্থীয় এর ৫, ৬ এবং ১৩ নং পদে এসেছে যেখানে আমরা পাই:
"কিন্তু যে কোন স্ত্রী অনাবৃত মস্তকে প্রার্থনা করে, কিম্বা ভাববাণী বলে, সে আপন মস্তকের অপমান করে; কারণ সে নির্ব্বিশেষে মুণ্ডিতার সমান হইয়া পড়ে।" (১ করিন্থীয় ১১:৫, অনুবাদ: কেরী)
"ভাল, স্ত্রী যদি মস্তক আবৃত না রাখে, সে চুলও কাটিয়া ফেলুক; কিন্তু চুল কাটিয়া ফেলা কি মস্তক মুণ্ডন করা যদি স্ত্রীর লজ্জার বিষয় হয়, তবে মস্তক আবৃত রাখুক।" (১ করিন্থীয় ১১:৬, অনুবাদ: কেরী)
"তোমরা আপনাদের মধ্যে বিচার কর, অনাবৃত মস্তকে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা কি স্ত্রীর উপযুক্ত?" (১ করিন্থীয় ১১:১৩, অনুবাদ: কেরী)
উপরের এই পদগুলোতে:
👉 মাথা ঢাকার (আবৃত বা covered এর) ক্ষেত্রে গ্রীক শব্দ κατακαλύπτω (katakaluptó) ব্যবহৃত হয়েছে;
👉 মাথা না ঢাকার (অনাবৃত বা uncovered এর) ক্ষেত্রে ἀκατακάλυπτος (akatakaluptos) ব্যবহৃত হয়েছে।
এখানে katakaluptó এবং akatakaluptos দুটি এক জাতীয় শব্দ - একটি হ্যাঁ-বাচক (আবৃতকরণের ক্ষেত্রে) এবং অন্যটি না-বাচক (অনাবৃতকরণের ক্ষেত্রে)।
👉 তাই আমরা সারাংশে বলতে পারি যে, প্রার্থনার সময় মাথার ঢাকার ক্ষেত্রে ১ করিন্থীয় ১১:৫,৬,১৩ নং পদে κατακαλύπτω (katakaluptó) শব্দের প্রয়োগ রয়েছে।
যদি এই মাথা ঢাকা বলতে মেয়েদের লম্বা চুলের আবরণ বোঝায়, তবে নিশ্চয় এই একই গ্রীক শব্দ "katakaluptó" ১ করিন্থীয়, ১১:১৫ পদেও থাকবে, কেননা সেখানে বলা হচ্ছিল:
"কিন্তু স্ত্রীলোক যদি লম্বা চুল রাখে; তবে তাহা তাহার গৌরবের বিষয়; কারণ *সেই চুল আবরণের পরিবর্ত্তে* তাহাকে দেওয়া হইয়াছে।"
(১ করিন্থীয়, ১১:১৫, অনুবাদ: কেরী)
কিন্তু আমরা দেখি যে, ১৫ নং পদে এখানে যে "আবরণ" বা "covering" এর কথা রয়েছে, তার জন্য ভিন্ন একটি গ্রীক শব্দ περιβόλαιον (peribolaion) ব্যবহৃত হচ্ছে; আগের জায়গাগুলোতে যে κατακαλύπτω (katakaluptó) ব্যবহৃত হচ্ছিল, সেই শব্দ এখানে ব্যবহৃত হচ্ছে না।
এথেকে বোঝা যায় যে, ১ করিন্থীয়, ১১:১৫ নং পদের "মস্তিষ্কের আবরণী" (head covering) আর পূর্বের ১ করিন্থীয়, ১১:৫,৬,১৩ পদগুলোর "মস্তিষ্কের আবরণী" (head covering) এর মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
কিন্তু ঠিক কী ধরণের পার্থক্য?
এটা জানতে চলুন ১০ এবং ১৫ নং পদ দুটি লক্ষ্য করিঃ
১০ নং পদ:
"এই কারণ স্ত্রীর মস্তকে কর্ত্তৃত্বের চিহ্ন রাখা কর্ত্তব্য—দূতগণের জন্য।" (১ করিন্থীয়, ১১:১০, অনুবাদ: কেরী)
১৫ নং পদ:
"কিন্তু স্ত্রীলোক যদি লম্বা চুল রাখে; তবে তাহা তাহার গৌরবের বিষয়..." (১ করিন্থীয়, ১১:১৫, অনুবাদ: কেরী)
সুতরাং আমরা পাই যে, যখন প্রার্থনার ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের আবরণ κατακαλύπτω (katakaluptó), তখন ১০ নং পদ অনুযায়ী তা কর্তৃত্বের চিহ্নবিশেষ (symbol of submission to the authority)। অন্যদিকে যখন লম্বা চুল মস্তিষ্কের আবরণীর ক্ষেত্রে περιβόλαιον (peribolaion), তখন তা ১৫ নং পদ অনুযায়ী নারীর গৌরবের বিষয় (glorious thing) যা প্রকৃতিগত (natural) - যা ঠিক আগের ১৪ নং পদে পুরুষের সাথে তুলনা করে উল্লেখ করা হয়েছে।[১] আর যা নারীর ক্ষেত্রে প্রকৃতিগত, তা অপসারণযোগ্য নয়, বরং তা চিরস্থায়ী (permanent)।
এথেকে বোঝা যায় যে, প্রার্থনার সময় মেয়েদের মাথার আবরণী চুল নয়, বরং ভিন্ন কিছু - যা কৃত্রিম (artificial) এবং অপসারণযোগ্য (removable) যেহেতু সেই আবরণী κατακαλύπτω (katakaluptó) হওয়ায় তা περιβόλαιον (peribolaion) এর প্রকৃতিগত আবরণী থেকে ভিন্ন ধরণের আবরণ!
এটা প্রমাণ করে যে, প্রার্থনার সময় মেয়েদের ভিন্ন কোনো আবরণী দিয়ে মাথা ঢাকতে হবে।
চুলকে মাথার আবরণের ব্যাখ্যা ধরা হলে এখানে আরও একটি সমস্যা চলে আসবে ৬ নং পদে যেখানে বলা হয়েছে:
"ভাল, স্ত্রী যদি মস্তক আবৃত না রাখে, সে চুলও কাটিয়া ফেলুক; কিন্তু চুল কাটিয়া ফেলা কি মস্তক মুণ্ডন করা যদি স্ত্রীর লজ্জার বিষয় হয়, তবে মস্তক আবৃত রাখুক।" (১ করিন্থীয়, ১১:৬, অনুবাদ: কেরী)
উক্ত পদে "চুল কাটিয়া ফেলা" এর ক্ষেত্রে মূল গ্রীক শব্দ κείρω (keiró) ব্যবহৃত হয়েছে - যার একটি অর্থ হল, চুল কেটে ছোট করে ফেলা।[২]
এক্ষেত্রে চুল ছোট করে ফেলার অর্থটি নিলে এবং মাথার আবরণীর ব্যাখ্যা 'লম্বা চুল' হলে, উক্ত ৬ নং পদটি আমরা এভাবে পাই:
"স্ত্রী যদি লম্বা চুল না রাখে, সে চুলও ছোট করিয়া ফেলুক..." (১ করিন্থীয়, ১১:৬)
এখানে এই বাক্যের কোনো অর্থ হয় না! কারণ স্ত্রী লম্বা চুল না রাখার অর্থ স্ত্রীর চুল ছোট হওয়া। আবার বলা হচ্ছে, সে চুল ছোট করে ফেলুক। তাহলে "স্ত্রীর যদি ছোট চুল থাকে, তবে সে চুল ছোট করে ফেলুক" - এর কোনো অর্থ নেই! এটি নিরর্থক বাক্য।
তাই ১ করিন্থীয়, ১১:৬ নং পদে "মস্তক আবৃত" এর ব্যাখ্যা লম্বা চুল নয়; বরং এখানে মাথার আবরণী চুল ব্যতীত অন্য কিছু - যা চুল থেকে আলাদা - যা প্রমাণ করে, প্রার্থনার সময় মেয়েদের পৃথকভাবে কোনো কাপড় দিয়ে মাথা ঢাকাই বাইবেলের নির্দেশ!
সবশেষে একটি বিষয় উল্লেখ করে লেখাটি শেষ করব। আর তা হল, প্রার্থনার সময় মেয়েদের মাথা ঢাকার সমর্থন আমরা প্রথম যুগের চার্চের ইতিহাসেও খুঁজে পাই। এর কয়েকটি রেফারেন্স নিম্নরূপ:
👉 সাধু পৌলের ১ করিন্থীয় লেখার মাত্র ১৫০ বছর পর প্রাথমিক যুগের খ্রিস্টান লেখক Tertullian (150–220 AD) তাঁর লেখনিতে উল্লেখ করেন যে, তাঁর সময়েও করিন্থীয় মণ্ডলীর মধ্যে 'মস্তিষ্ক আবৃতকরণ' (head covering) এর চর্চা প্রচলিত ছিল:
"So, too, did the Corinthians themselves understand [Paul]. In fact, at this day the Corinthians do veil their virgins. What the apostles taught, their disciples approve."[৩]
👉 এছাড়াও Titus Flavius Clemens নামক একজন প্রাথমিক যুগের খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ববিদ যিনি Clement of Alexandria (150–215 AD) নামেও পরিচিত - তিনি আবরণী (veil) এর উল্লেখ করে লিখেছেন,
"Woman and man are to go to church decently attired...for this is the wish of the Word, since it is becoming for her to pray veiled."[৪]
👉 আরেকজন প্রাথমিক যুগের রোমান ধর্মতত্ত্ববিদ Hippolytus (170–236 AD) মণ্ডলীকে উপদেশ দেওয়ার জন্য মেয়েদের 'মস্তিষ্ক আবৃতকরণ' সম্পর্কে বলেন,
"...let all the women have their heads covered with an opaque cloth..."[৫]
"Early church history bears witness that in Rome, Antioch, and Africa the custom [of wearing the head covering] became the norm [for the Church]."[৬]
👉 Origen Adamantius নামক আরেক প্রাথমিক যুগের খ্রিস্টান পণ্ডিত যিনি Origen of Alexandria (c. 184 – c. 253) নামে পরিচিত - তিনি মেয়েদের প্রার্থনার ক্ষেত্রে 'মাথার আবরণ' (head covering) এর কথা উল্লেখ করে লিখেছেন,
"There are angels in the midst of our assembly... we have here a twofold Church, one of men, the other of angels... And since there are angels present... *women, when they pray, are ordered to have a covering upon their heads* because of those angels. They assist the saints and rejoice in the Church."[৭]
আর স্বাভাবিকই প্রাথমিক যুগের খ্রিস্টান পণ্ডিতদের শাস্ত্রকে বোঝার দক্ষতা নিশ্চয় শাস্ত্রের বিষয়বস্তু বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ!
.
.
.
______________________
ফুটনোট:
[১] "স্বয়ং প্রকৃতিও কি তোমাদিগকে শিক্ষা দেয় না যে, পুরুষ যদি লম্বা চুল রাখে, তবে তাহা তাহার অপমানের বিষয়" (১ করিন্থীয়, ১১:১৪, অনুবাদ: কেরী)
[২] Thayer's Greek Lexicon অনুযায়ী, κείρω (keiró) এর একটি অর্থ হল "cutting short the hair of the head"
source 1:
https://www.studylight.org/lexicons/eng/greek/2751.html
source 2:
https://bibleapps.com/greek/2751.htm
[৩] Tertullian. (1885). On the Veiling of Virgins. In A. Roberts, J. Donaldson, & A. C. Coxe (Eds.), S. Thelwall (Trans.), Fathers of the Third Century: Tertullian, Part Fourth; Minucius Felix; Commodian; Origen, Parts First and Second (Vol. 4, p. 33). Buffalo, NY: Christian Literature Company.
source of the reference - Wikipedia
link - https://en.m.wikipedia.org/wiki/Christian_head_covering
[৪] Clement of Alexandria. (1885). The Instructor. In A. Roberts, J. Donaldson, & A. C. Coxe (Eds.), Fathers of the Second Century: Hermas, Tatian, Athenagoras, Theophilus, and Clement of Alexandria (Entire) (Vol. 2, p. 290). Buffalo, NY: Christian Literature Company.
source of the reference - Wikipedia
link - https://en.m.wikipedia.org/wiki/Christian_head_covering
[৫] Hippolytus, and Easton, B. (1934). The Apostolic tradition of Hippolytus. New York: Macmillan, p.43.
source of the reference - Wikipedia
link - https://en.m.wikipedia.org/wiki/Christian_head_covering
[৬] Johnson, Lewis (1962). The Wycliffe Bible Commentary. Chicago: Moody Press. pp. 1247–1248.
source of the reference - Wikipedia
link - https://en.m.wikipedia.org/wiki/Christian_head_covering
[৭] source of the reference - Wikipedia
link - https://en.m.wikipedia.org/wiki/Christian_head_covering
Thursday, September 16, 2021
Author: Admin
Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.
0 coment rios: