Saturday, January 28, 2023

মুসলিমদের উপাস্য "আল্লাহ" কে?

মুসলিমদের উপাস্য "আল্লাহ" কে?

আল্লাহ ইসলামের উপাস্য ঈশ্বর। এটি দুটি শব্দের একটি যুক্তবর্ণ। আল ও লাহ। আল+লাহ=আল্লাহ। আল্লাহ শব্দটি "লাহ" নামক উপাস্যকে নির্দেশ করে। আল্লাহ শব্দের প্রথমে যুক্ত আল অক্ষরটি ইংরেজি আর্টিকেল 'The' এর প্রতিশব্দ যা লাহ নামক উপাস্যের নির্দিষ্টতা নির্দেশ করে। লাহ শব্দটি "ইলাহ" শব্দের আদিরূপ। "আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নাই" এখানে ইলাহ শব্দের অর্থ যেমন উপাস্য তেমনি লাহ শব্দ দ্বারাও উপাস্য বুঝায়। কোন শব্দের আগে আল যুক্ত করে সেই শব্দের অর্থকে নির্দিষ্টতা দেয়া আরবি ভাষার একটা সাধারণ রীতি। আরবের পৌত্তলিকরাও তাদের উল্লেখযোগ্য দেব দেবীর নামের আগে "আল" শব্দটি ব্যবহার করত, যেমন আল-উজ্জা, আল-লাত, আল-মানাত ইত্যাদি। আবার আল্লাহর অনেক গুণবাচক নামের আগেও এই "আল"-এর ব্যবহার হয়েছে (আল-খালিকু, আল-মালিকু ইত্যাদি)। আমরা যদি " আলহামদুলিল্লাহ" শব্দটির দিকে খেয়াল করি, তাহলে এখানেও এই শব্দটি "লাহ" নামক ঈশ্বরের দিকে নির্দেশ করে। এর শব্দবিভাজন এমন, আল(The)- হামদু(praise)- লি(to)-লাহ্(Lah)। অর্থাৎ লাহ্ এর প্রশংসা। 


 প্রশ্ন আসতে পারে এই " লাহ" নামের উৎপত্তি কোথা থেকে? প্রায় ১৮০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দের ব্যাবিলনীয় উপকথা "ইনুমা ইলিশ" এ  লাহ নামযুক্ত দুটি দেবতার নাম পাওয়া যায়। ইনুমা ইলিশের এক নম্বর ট্যাবলেটের ১০ নম্বর পংক্তিতে ও তিন নাম্বার ট্যাবলেটের ৬৮ এবং ৬৯ পংক্তিতে আমরা এদের নাম উল্লেখ দেখতে পাই। এদের একজন লাহ মু ওআরেকজন লাহ আমু। ইনুমা ইলিশের লিংক এখানে দেয়া হল।


https://www.worldhistory.org/article/225/enuma-elish---the-babylonian-epic-of-creation---fu/ 


ধারণা করা যায় কোন চরিত্রকে ঐশ্বরিক বুঝাতে লাহ শব্দটি ব্যবহৃত হত। 


বসরা স্কুলের ব্যাকরণবিদরা [ বসরার প্রথম ব্যাকরণবিদরা সপ্তম শতাব্দীতে আল-বাসরাতে বসবাস করতেন। শহরটি, যেটি একটি সামরিক ছাউনি থেকে বিকশিত হয়েছিল, যেখানে ভবনগুলি প্রায় ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল, যা সমগ্র ইসলামী বিশ্বের ব্যাকরণবিদ, ভাষাবিদ, কবি, ভাষাতত্ত্বজ্ঞ, বংশতালিকাবিদ, ঐতিহ্যবিদ, প্রাণিবিদ, আবহাওয়াবিদ এবং সর্বোপরি কুরআনের তাফসির ও হাদিসের ব্যাখ্যাকারীদের মিলনকেন্দ্র ছিল ।  ইসলামের স্বর্ণযুগের এই পণ্ডিতরা ছিলেন সাহিত্য শৈলী এবং বিস্তৃত অর্থে আরবি ব্যাকরণের বিজ্ঞানের পথপ্রদর্শক]   আল্লাহ শব্দটিকে "স্বতঃস্ফূর্তভাবে" (মুর্তাজাল) বা লাহ-এর নির্দিষ্ট রূপ হিসাবে গণ্য করেছেন ("উচ্চ" বা "লুকানো" অর্থ সহ মৌখিক মূল lyh থেকে)


[সূত্রঃ D.B. Macdonald. Encyclopedia of Islam, 2nd ed, Brill. "Ilah", Vol. 3, p. 1093.]


আবার উত্তর আরবের তাইমা-তে পাওয়া প্রাচীণ শিলালিপিতে "লামে'হ" (লক্ষ্য করুন ব্যাবিলনীয় দেবতা "লাহ মু" এর সাথে মিল) নামে একজন দেবতার উল্লেখ পাওয়া যায় যাকে "অতি উজ্জ্বল তারকা" বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তাদের একজন দেবতার উপাধি দেওয়া হয়েছিল "রাহিম"। ধারণা করা যায় এটা সেই " তারকা" দেবতা লামে'হ[সূত্রঃ F.V. Winnett and W.L. Reed, Ancient Records from North Arabia,  page 103]। 


সুতরাং আমরা অবশ্যই এই ধারণা করতে পারি "লাহ" শব্দটি ব্যাবিলনে অগুরুত্বপূর্ণ দেবতার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকলেও বহু পরে কালের পরিক্রমায় আরব অঞ্চলে উপাস্য দেবতাগুলোর উপাধি হিসাবে স্থান করে নেয়। একটা বিষয় খেয়াল করুন এখানে বলা হয়েছে দেবতাগুলোর উপাধি হিসাবে স্থান করে নেয়। অর্থাৎ লাত একজন আল্লাহ, উজ্জা একজন আল্লাহ, হুবাল একজন আল্লাহ। হিন্দুদের পটভূমিতে যদি বিষয়টি বুঝাতে চাই তাহলে বলতে হয়, হিন্দুরা যেমন দুর্গাকে একজন ঈশ্বর মনে করে তেমনি কৃষ্ণকেও ঈশ্বর মনে করে। অর্থাৎ উপাস্য আর ঈশ্বর এক্ষেত্রে সমার্থক। আরবের লোকরাও কিন্তু কেউ কেউ হয়ত এইসব আল্লাহর মাঝে কোন আল্লাহকে প্রধান আল্লাহ বলে মনে করত। কিন্তু এটা ব্যক্তিবিশেষে পার্থক্য হত। কেউ হয়ত মান্নাতকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ আল্লাহ বলে মনে করত আবার কেউ বা হুবালকে। তবে অধিকাংশ কুরাইশ হুবালকেই প্রধান আল্লাহ বলে মনে করত[সহীহ বুখারী, ইসলামি ফাউন্ডেশন, হাদিস নং ২৮২৫, অধ্যায়ঃ জিহাদ]। এভাবেই আল্লাহ উপাধিটি উপাস্য বুঝাতে আরবের সাধারণ ভাষা হিসাবে স্থান করে নেয় যা যে কোন দেবতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। পরে ঈশ্বরের সাধারণ নাম বুঝাতে অন্য আরবভাষী জাতিগোষ্ঠীও(আরবভাষী ইহুদী ও খ্রীষ্টিয়ানরা) তাদের উপাস্যকে "আল্লাহ" বলে উল্লেখ করত যদিও তারা আল্লাহ বলতে অবশ্যই মক্কার উপাস্যকে বুঝাত না। মুহাম্মদ এই আল্লাহ বলে কোন দেবতাকে বুঝাচ্ছে তা নিয়ে কুরাইশদের মাঝেই বিভ্রান্তি ছিল, কারণ এটি কোন আল্লাহকে বুঝাচ্ছে তা মুহাম্মদ স্পষ্ট করেননি। এটি কুরআনে আয়াতের মধ্য দিয়েও প্রকাশিত হয়েছে-


Sad ৩৮:৫


أَجَعَلَ ٱلْءَالِهَةَ إِلَٰهًا وَٰحِدًاۖ إِنَّ هَٰذَا لَشَىْءٌ عُجَابٌ 


Bengali - Bayaan Foundation


সে কি সকল উপাস্যকে এক ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে? নিশ্চয় এ তো এক আশ্চর্য বিষয়’!


English - Sahih International


Has he made the gods [only] one God? Indeed, this is a curious thing."


অনেকেই আল্লাহ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত বিশ্লেষণ না করেই বা এ সম্পর্কে যথেষ্ট গবেষণা না করেই আল্লাহকে সেমেটিক ঈশ্বরের প্রতিশব্দ এল, এলোহিম, আলাহা বা এলোহা এর সাথে সম্পর্কযুক্ত করে থাকেন। এল, এলোহিম, আলাহা বা এলোহা প্রত্যেকেই পৃথক শব্দ যে সকলের সাথে নির্দিষ্টবাচক Article আল শব্দটি যুক্ত নেই যেটি আল্লাহর ক্ষেত্রে আছে। আল্লাহর ক্ষেত্রে মূল শব্দ লাহ আর এল, এলোহিম, আলাহা, এলোহার ক্ষেত্রে মূল শব্দ এল বা আল যার সাথে প্রত্যয়যুক্ত হয়ে এলোহিম, আলাহা, এলোহা শব্দসমূহের উৎপত্তি ঘটেছে। সুতরাং এলোহিম, আলাহা, এলোহা শব্দগুলো কোনক্রমেই আল্লাহ শব্দের ভিন্ন উচ্চারণ নয় বরং আল্লাহ-এর সাথে এই শব্দগুলোর দূরতমও কোন সম্পর্ক নেই। বাইবেলে ঈশ্বর/আল্লাহ এর প্রতিশব্দ এলোহিম। আর এলোহিমের নাম উচ্চারণভেদে ইয়াওয়ে/ইয়াহুয়া। বাইবেল তাঁর ঈশ্বরকে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেছে। কুরআনের মাঝে যে-রকম আল্লাহ নামক গণ টার্মকেই ঈশ্বর বলে অভিহত করে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে বাইবেলে তা করা হয়নি। এলোহিম ইয়াহুয়া বলেন-


✡️এছাড়াও এলোহিম(ঈশ্বর/আল্লাহ) মোশিকে বললেন, “ইস্রায়েলীদের বোলো, ‘ইয়াহুয়া, তোমাদের পূর্বপুরুষদের এলোহিম—অব্রাহামের এলোহিম, ইস্‌হাকের এলোহিম ও যাকোবের এলোহিম—আমাকে তোমাদের কাছে পাঠিয়েছেন।’

“এটিই আমার অনন্তকালীন নাম,

যে নামে তোমরা আমায়

প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ডাকবে।”

যাত্রা পুস্তক 3:15✡️


মুহাম্মদ ঈশ্বরের নাম দিয়েছিলেন "আল্লাহ" যা ছিল একটি সাধারণ নাম বা common name । যেমন "মানুষ" হচ্ছে আমাদের কমন নেম। এই common name কোন ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট করেনা। মুহাম্মদ স্বভাবতই হুবাল বা অন্য কোন আরবীয় দেবতার নাম নিতে পারছিলেননা কারণ তা করলে ইহুদি খ্রীষ্টিয়ানদের সাথে বিরোধ সৃষ্টি হবে যেহেতু তারা মক্কার কোন উপাস্যকে আল্লাহ মানে না। তারা আল্লাহ মানে ইয়াওয়ে/ইয়াহুয়াকে। কিন্তু মুহাম্মদ ইয়াওয়ে নামটি জানত না কারণ ইহুদি খ্রীষ্টিয়ানরা এই নাম মহাপবিত্র বলে মানত বলে কখনও উচ্চারণ করত না। একমাত্র জেরুশালেম মন্দিরে বছরের একটা সময়ে এই নাম ইহুদি মহাইমাম দ্বারা একবার উচ্চারিত হত। সুতরাং মুহাম্মদ এই নাম কারো মুখে শুনেননি, এই ব্যাপারে জানতেও পারেননি। তিনি যদি সত্যই ঈশ্বর থেকে বাণী পেতেন তাহলে অবশ্যই ঈশ্বর এই পবিত্র নাম তাঁকে জানাতেন আর একবারের জন্য হলেও আল্লাহ এই পবিত্র নামের কথা মনে করিয়ে দিতেন, যেমন বাইবেলে ঈশ্বর করেছেন।


কুরআনে আল্লাহকে "ক্বাবার প্রভু" হিসাবে বলা হয়েছে(কুরআন ১০৬:৩)। কিন্তু এই প্রভুর নাম কি? অবশ্যই ইয়াওয়ে নন। কারণ এই নাম আরবরাও জানত না, মুহাম্মদও না। ইয়াওয়ে কখনও নিজেকে আরবের এই ক্বাবার সাথে নিজেকে সংশ্লিষ্ট করে কিছু বলেননি। তাহলে কে ছিল এই কাবার প্রভু আল্লাহ? 


কুরআনের একটি আয়াতে আমরা আল্লাহর নাম "রাহমান" হিসাবে দেখি-

Ar-Ra'd ১৩:৩০ كَذَٰلِكَ أَرْسَلْنَٰكَ فِىٓ أُمَّةٍ قَدْ خَلَتْ مِن قَبْلِهَآ أُمَمٌ لِّتَتْلُوَا۟ عَلَيْهِمُ ٱلَّذِىٓ أَوْحَيْنَآ إِلَيْكَ وَهُمْ يَكْفُرُونَ بِٱلرَّحْمَٰنِۚ قُلْ هُوَ رَبِّى لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَإِلَيْهِ مَتَابِ Bengali - Bayaan Foundation এমনিভাবে আমি তোমাকে পাঠিয়েছি এমন এক জাতির নিকট, যার পূর্বে অনেক জাতি গত হয়েছে, যেন আমি তোমার প্রতি যে ওহী প্রেরণ করেছি, তা তাদের নিকট তিলাওয়াত কর। অথচ তারা রহমানকে অস্বীকার করে। বল, ‘তিনি আমার রব, তিনি ছাড়া আর কোন (সত্য) ইলাহ নেই, তাঁরই উপর আমি তাওয়াক্কুল করেছি এবং তাঁরই দিকে আমার প্রত্যাবর্তন’। English - Sahih International Thus have We sent you to a community before which [other] communities have passed on so you might recite to them that which We revealed to you, while they disbelieve in the Most Merciful. Say, "He is my Lord; there is no deity except Him. Upon Him I rely, and to Him is my return." Bengali - Mujibur Rahman এভাবে আমি তোমাকে পাঠিয়েছি এক জাতির প্রতি, যার পূর্বে বহু জাতি গত হয়েছে, তাদের নিকট আবৃত্তি করার জন্য, যা আমি তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করেছি; তথাপি তারা দয়াময়কে অস্বীকার করে। তুমি বলঃ তিনিই আমার রাব্ব! তিনি ছাড়া অন্য কোন মা‘বূদ নেই, তাঁরই উপর আমি নির্ভর করি এবং আমার প্রত্যাবর্তন তাঁরই কাছে। ✅


এই রাহমান-এর অনুবাদ মুসলিম অনুবাদকরা "দয়াময়" হিসাবে করলেও বস্তুত এটি একটি নাম যে আরবের সাবিয়ান-রা তাদের উপাস্য দেবতাকে ডাকত-


In the Late Sabaic period the ancient names of the gods are no longer mentioned and only one deity Raḥmānān is referred to. The last known inscription in Sabaic dates from 554 or 559 AD.


Reference : [Nebes, Norbert; Stein, Peter (2008). "Ancient South Arabian". In Woodard, Roger D. (ed.). The Ancient Languages of Syria-Palestine and Arabia (PDF). Cambridge: Cambridge University Press. pp. 145–178. doi:10.1017/CBO9780511486890ISBN 9780511486890. ]



শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: